সত্যম শিবম সুন্দরম

Dr Gautam Ghosh
4 min readOct 26, 2020

--

২০১৫ সালে ধর্মীয় ব্যঙ্গচিত্র ছেপে জঙ্গি হানার শিকার হয়েছিল ফরাসি ব্যঙ্গ-পত্রিকা শার্লি এবদো। সেই ঘটনা নিয়েই ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে ফ্রান্সের এক স্কুলশিক্ষকের মাথা কেটে খুন করা হল সম্প্রতি। আবার, ‘অনাবৃত ভারতমাতা’ বা ‘নগ্ন সরস্বতী’ অঙ্কনে অকুণ্ঠ ছিলেন বিরল মকবুল ফিদা হুসেন। সে সব চিত্রের বিরুদ্ধে যত বিক্ষোভ হয়েছে সব কিন্তু ‘হিন্দুত্ববাদী’ আখ্যা পেয়েছে ! যীশুকে নিয়ে দু চারটে কার্টুন আঁকা হলেও, নগ্ন যীশুর ছবি কিন্তু কেউ আঁকেন নি। বুদ্ধ বা মহাবীর তো দূর অস্ত।

এ প্রসঙ্গগুলি আনতে হল সম্প্রতি এবিপি আনন্দে শিবের কেস ডায়রি কার্টুন ভিডিওটি দেখে।অবিমৃষ্যকারী সম্পাদনা। এ হল ধান ভাঙতে শিবের গীত — — মূল কথা সম্পূর্ন অন্য, তবু হিন্দু দেব-দেবীদের নিয়ে অলীক কুনাট্যের অবতারণা — একেবারেই অপ্র্য়োজনে! সরকারি নীতির বিরুদ্ধ-সমালোচনা করার জোর নেই , তাই শিবকে আগে অপমান করা — যেন মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে নেয়া। দোহাই হিসেবে শিবকে ব্যবহার করা। ভারতচন্দ্রের একটি পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে — অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ / কোন গুণ নাহি তার কপালে আগুণ … মা দুর্গার বয়ানে শিবের নিন্দাচ্ছলে স্ততি । প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনা ভিন্ন।

এই ব্যজস্তুতিতে ভারতচন্দ্র মনে রেখেছিলেন, মহেশ্বরকে নিয়ে রসিকতা করলেও স্মরণ রাখতে হবে, তিনি দেবাদিদেব …বেদ, সংহিতা ,পুরান, মহাভারত … ভারতীয় দর্শন ও শিল্পের সর্বত্রই পূজিত। সিদ্ধিতে নিপুন -এর অর্থ তাঁর আড়াই সের সিদ্ধি খাওয়া নয় , তিনিই হলেন সাফল্য বা সিদ্ধির রূপ। ভারতের ধ্রুপদীচিন্তার তিনি আকর এবং উৎস। অদ্বৈত এবং দ্বৈত — দুই মতবাদেই তিনি সমভাবে স্বীকৃত। তাঁর লোকায়ত প্রতিষ্ঠার জন্যই শিবের লৌকিকরূপের অবতারণা। প্রতিটি পূজার আরম্ভে তাঁকে স্মরণ করার রীতি।

দেব-দেবীদের নিয়ে অশোভন রসিকতার শুরু ১৮ শতকে নিম্নরুচির এক শ্রেণীর পালাকার, কবিয়ালদের মুখে … অল্পবিদ্যার সাহসে এ বোধ তাঁদের ছিল না যে তাঁদেরই পূজ্য দেবতাকে তাঁরাই যদি অপমান করেন, তা হলে অন্য ধর্মবিশ্বাসের মানুষ না আস্থা রাখবেন তাঁর উপর, না শ্রদ্ধা করবেন তাঁর বিশ্বাসকে। ঘটেওছিল ঠিক তাই …। কিন্তু ‘সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে’ — শিবের কেস ডায়রি কার্টুন ভিডিওটিতেও তার পরিচয়। এই ব্যঙ্গকে হাতিয়ার করে আজ যদি অন্য ধর্মবিশ্বাসের কেউ ঠিক এমনই এক পরিবেশনা তৈরি করে, তা হলেই শুরু হয়ে যাবে উত্তেজনা, হানাহানি।অথবা, এই ভাঁড়ামোর ফলে যে সব মানুষের হিন্দু-মানসিকতায় আঘাত লাগলো , তার যদি অকস্মাৎ বিস্ফোরণ ঘটে, সে দায় কি এই অবোধ সম্পাদক নেবেন ? তখন কেউ মনে রাখবেন না, এই অশান্তির আগুন আমরাই জ্বেলেছি আমদের মূর্খতায়। আত্মঘাতী এই মানসিকতাকে থেকে আমরা মুক্ত হব কবে !

ভাঁড়ামো এবং রসিকতার মধ্যে যে একটা চারিত্রিক তফাৎ আছে ,সেটি বোঝার এবং আয়ত্ত করার ক্ষমতা এ সম্পাদকের নেই। ঠিক এই রকমের কার্টুন কি ইদ বা বড়দিনের আগে প্রকাশ করতে পারবেন ? উনি জানেন যে সেটা একান্তই অসম্ভব ! চাকরি ত যাবেই, আইনি হেনস্থা এমন কি মৃত্যুও হতে পারে, সুতরাং সে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। তাই, ভাঁড়ের স্বভাব অনুযায়ী নিজেকে পণ্ডিত বলে জাহিরের চেষ্টা…… তাতে যদি শিব দুর্গা বা লক্ষ্মীর অবমাননা হয়, কুছ পরোয়া নেই। হিন্দুরা তো কিছু বলে না, অতি নিরীহ প্রাণী! বিদ্যা বা ভারতমাতাকে যে আবৃত বা অনাবৃত কিছুই করা যায় না , তিনি যে একটি ধারনার কল্প-রূপ মাত্র , সেই মাত্রা জ্ঞান হুসেনের ছিল না … তিনি মূঢমতিতে আঘাত হেনেছিলেন সাধারণ গণ- মানসে …।সে কারণেই দেশ জুড়ে এত বিক্ষোভ … এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দেশ-ত্যাগ।

যে কোন মানুষেরই ব্যক্তি-রুচি ও চিন্তার অধিকার আছে। কিন্তু সে চিন্তা বা রুচি প্রকাশ্যে আনবেন কি না, তার উপরেই নির্ভর করে সেই ব্যক্তি-মানুষের শিক্ষা ! হুসেন যা খুসি ভাবতে পারেন এবং আঁকতেও পারেন — তা নিয়ে কারুরই মাথা-ব্যথা নেই । কিন্তু বিপত্তি বাঁধল প্রকাশ্য হতেই । সুমনও যা খুশি ভাবতে পারেন, কিন্তু আনন্দবাজারের মত একটি গণ-মাধ্যমে তার কার্টুন-ভিডিও প্রকাশ হবে কি না , সেটি আমাদের সবার চিন্তার! ভিডিওটির আরম্ভে বিস্তর গুরু-গম্ভীর প্রস্তাবনা আছে, সেটি লেখার সঙ্গে সুমন আবার পাঠও করেছেন। কিন্তু যা পড়লেন, তার মর্মোদ্ধার করেছেন কি ? করলে এত অশালীন একটি ভাঁড়ামো পরিবেশন করতেন না ।

হুসেনের ঘটনা প্রায় ১৫ বছর আগের । তখন সামাজিক বা ধর্মীয় বাতাবরণ ছিল অনেক শান্ত । তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বা শাসকদল ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন ! কিন্তু বিশ্বজুড়ে আজ যেখানে ধর্ম নিয়ে এই স্পর্শকাতরতা, সেখানে সহিষ্ণুতার কথা কি নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারেন ? অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন এক রসিকতা যে সারা দেশকে বিষম বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে , সে কথা ভাবলেন না এই সম্পাদক!উনি কি জানেন না, স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকাণ্ড হতে সময় লাগে খুবই অল্প?

--

--

Dr Gautam Ghosh
Dr Gautam Ghosh

Written by Dr Gautam Ghosh

Dr Ghosh is often referred to as the moving think tank of Asia . A Prolific Author,, Proficient Advocate , Philanthropist, -a public figure loved by most

No responses yet